বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ
এক পরিচিতের বাসায় গিয়েছি। দেখলাম একটা ৪/৫ বছরের বাচ্চাকে তার মা শলার ঝাড়ু দিয়ে বাড়ি দেয়ার ভয় দেখাচ্ছে, জোরে বিছনায় একটা বাড়িও দিলো। বাচ্চাটা ভয়ে কেঁপে উঠলো। ঐ মহিলা যদি জানতো, এটা কতটা ভয়াবহ একটা ব্যপার তাহলে এই কাজ কখনোই করতো না। বাচ্চাটার চেহারা দেখেই তার অনুভূতি বোঝা যাচ্ছিলো। কিন্তু ভেতরে যে তারচাইতেও ভয়াবহ ব্যপার ঘটছে, সেটা আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে খুব ভালো জানি। ছোটবেলা আমাকে একবার ঝাড়ু দিয়ে ভয়াবহভাবে মারা হয়েছিলো। সেই ট্রমা আমার এখনো কাটে নাই।
এদেশের দু'টো জিনিষের জরুরী ভিত্তিতে সংস্কার প্রয়োজন। ১) শিক্ষা ব্যবস্থা, ২) প্যারেন্টিং। এই দু'টো ব্যপার ঠিক না করলে একটা সুস্থ জাতি আপনি কোনভাবেই আশা করতে পারেন না।
বাঙালি খুব বিচিত্র। তাদের মোবাইলের বাজেট হইলো ৫ হাজার কিন্তু কোয়ালিটি খোঁজে আইফোনের। ডাক্তাররে ফি দিবো ৫০০ টাকা কিন্তু সার্ভিস চাইবো আম্রিকান। পকেটে আছে দশ হাজার, বানাইতে চায় আমাজন+গুগল+ফেসবুক।
এই দ্যাশে আপনে ব্যবসা করবেন কেমনে?
যদিও এই যাত্রা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাওয়ার সম্ভবনা নাই বললেই চলে, তবুও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কখনো না কখনো অবশ্যই লাগবে। যতদিন এই ঝুঁকির ভেতরে আমরা আছি, ততদিন দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকা ভালো। দুর্যোগ মোকাবিলার ভালো উপায় হচ্ছে সবচাইতে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা। সুতরাং ধরে নেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগবে, আজ না হোক কাল। তারপর কী হবে?
পৃথিবী এখন এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে- তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে পৃথিবীর বর্তমান সকল টেকনোলজি হারিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা সবচাইতে বেশী। কেউ যুদ্ধ জেতার জন্য পৃথিবী ধ্বংস না করলেও হেরে যাওয়ার মূহুর্তে 'আমিও নাই তুমিও নাই কেমন মজা হবে' টাইপ আনন্দ নেয়ার জন্য এই কাজটা করবে। এটাকে বলে consolation যার ভালো কোন বাংলা প্রতিশব্দ নাই।
তো তারপর কি হবে বলেন তো? জীবিকার তাগিদে পৃথিবীর মানুষকে আবার কৃষিতে ফিরে যেতে হবে। চিকিৎসার জন্য ভেষজে (যদিও এখনি মানুষ ভেষজের পথে রওনা দিয়েছে)।
আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন বাধ্যতামূলক কৃষিবিজ্ঞান ছিলো। এখন আছে কিনা জানি না, তবে থাকা জরুরী। সাথে আউট বই হিসেবে আরো কিছু কৃষি বিষয়ক বই সবার পড়া উচিত, সম্ভব হলে প্রাকটিক্যালি কিছুদিন কৃষি কাজও করা উচিত। আর প্রতিটা ফ্যামিলিতে কমপক্ষে একজনের ভেষজ নিয়ে পড়াশোনা থাকা উচিত, প্রাকটিক্যাল সহ।
এই ব্যপারটা পারিবারিক ঐতিহ্যে পরিনত করুন। আপনার না হোক, পরবর্তী প্রজন্মের অনেক কাজে আসবে।
আরেকটা ব্যপার, এরকম কোন ব্যপার ঘটে গেলে বাংলাদেশের মত পলিবিধৌত ভূমিগুলো হবে স্বর্ণের খনির মত। সুতরাং দেশ থেকে পলায়নরত বন্ধুগন, দেশে কিছু জায়গা জমি কিনে রাইখেন।
ভালো রেজাল্ট, উচ্চতর ডিগ্রি, ভালো ক্যারিয়ার, টাকা পয়সা... এগুলো কি মানুষের মানসিকতা বদলাতে পারে যদি সে নিজে না চায় বা ফ্যামিলি তাকে সেভাবে শিক্ষা না দেয়? নাহ... অনেক তো দেখলাম!
এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা না, এটা মনুষ্য জাতির সীমাবদ্ধতা।
আমার প্রফেশনাল ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিলো হসপিটালের ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার বানানোর মাধ্যমে। প্রথম সফটওয়্যারটা বানিয়েছিলাম একটা হাসপাতালে বসে। ওখানে আমার জন্য একটা রুম বরাদ্দ ছিলো। আর যে ডাক্তার আংকেলের হাসপাতালের সফটওয়্যার বানাচ্ছিলাম, তাঁর একটা গবেষণায় সাহায্য করার জন্য একটা এনালাইসিস টুলও বানাচ্ছিলাম যেটার জন্য উনার ব্যাক্তিগত প্রাকটিস চেম্বারে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে হয়েছে। রোগীর চাপ একটু কমে আসলেই টুলটা ডেভেলপের জন্য উনার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ইনপুট আর দিকনির্দেশনা নিতাম। তো, খোদ ডাক্তারের চেম্বারে দীর্ঘদিন সময় কাটানোর দরুন বাংলাদেশের রোগীদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিলো। এছাড়াও পরবর্তী ৫/৬ বছর দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই হসপিটাল সিস্টেম ডেভেলপ, সাপোর্ট দিতে গিয়ে আরো অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- এই দেশে অল্প কিছু খারাপ ডাক্তারের পাশাপাশি অনেক ভালো ডাক্তার আছে। আর আছে অসংখ্য বিবেকহীন মূর্খ রোগী ও রোগীর আত্মীয়স্বজন।
ঢাকার কয়েকটা দামী হাসপাতাল বাদ দিলে, বাংলাদেশের বেশির ভাগ হাসপাতাল/ক্লিনিকের রোগীদের ভেতরে শতকরা ৯০ ভাগ রোগী এবং রোগীর আত্মীয় স্বজনরা ডাক্তারদের সাথে অন্যায় ভাবে খারাপ ব্যবহার করে। আর ডাক্তাররা যে কতটা ধৈর্য নিয়ে রোগী ও রোগীদের আত্মীয় স্বজনদের অত্যাচার/খারাপ ব্যবহার সহ্য করে, বলার মত না। সামান্য ২০০-৫০০ টাকা ভিজিট দিয়ে বেশির ভাগ মানুষই ভাবে ডাক্তার সাহেবকে তিনি কিনে ফেলেছেন। সবচাইতে বিরক্তিকর ব্যপার হচ্ছে ডাক্তারদের উপরে ডাক্তারী। অনেক রোগী দেখেছি, যাদের আসলেই কোন সমস্যা ছিলো না। ডাক্তার তাদেরকে সেটা বললে তারা চেম্বার থেকে অর্ধেক বের হয়েই ডাক্তারকে গালাগালি শুরু করতো আর বলতো- 'এই ডাক্তার ভালা না, অমুক ডাক্তারের কাছে যাইতে হইবো'। এটা নাকি বেশ কমন ঘটনা... তাই ডাক্তাররা বাধ্য হয়েই অনেক রোগীকে ফলস ঔষধ দিয়ে থাকে (যেটা আসলে কোন ঔষধই না)। অনেক ক্ষেত্রে একজন ডাক্তার ভালো মানুষ হওয়ার পরেও খামোখাই নানারকম টেস্ট দিতে বাধ্য হয়, নয়তো রোগীর লোকজন ভাবে এই ডাক্তার কিছু জানে না।
সবচাইতে খারাপ ব্যপার হচ্ছে- ডাক্তারদের সঠিক চিকিৎসার পরেও কোন রোগী মারা যাওয়ার পর আত্মীয় স্বজনদের ভুল চিকিৎসার অপবাদ দেয়া। এই সমস্যাটা ঢাকার অনেক নামীদামী হাসপাতালে অনেক শিক্ষিত ও উচ্চবিত্তদের ভেতরেও দেখেছি। বেশ কয়েকবার আমার সামনেই রোগীর প্রভাবশালী আত্মীয় স্বজনরা হাসপাতাল ভাংচুর করেছে।
অনেক সময় এরকম হয় যে- রোগীর বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ! স্পেশাল কিছু ট্রিটমেন্ট আছে যেটা দিলে বাঁচতেও পারে, আবার নাও পারে। ডাক্তাররা দ্রুত সেই ট্রিটমেন্ট দিয়ে ফেলেন। এতে কেউ কেউ বেঁচে যায়, অনেকেই মারা যায়। কিন্তু রোগীর আত্মীয় স্বজনদের বেশির ভাগই এই ব্যপারটা বুঝতে চায় না, তারা হাসপাতাল আর ডাক্তারদের দায়ী করে বসে। কয়েকদিন আগে গাজীপুরো এরকম একটা ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ডাক্তার আর ওয়ার্ড বয়কে পুলিশ দিয়েই ধরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেছে রোগীর প্রভাবশালী আত্মীয়। ওখানে যে ট্রিটমেন্টটা দেয়া হয়েছিলো সেটা নিয়ে বেশ কয়েকজন ডাক্তার বন্ধুর সাথে কথা বললাম। সকলেই বললেন- ট্রিটমেন্ট ভুল ছিলো না।
রোগীর আত্মীয় স্বজনরা হাসপাতাল ভাংচুর বা অন্য কোন ক্ষতি করলে সেটা হাসপাতাল মালিকরা পুষিয়ে নিতে পারে। কিন্তু যদি সরাসরি এর জন্য ডাক্তারদের এভাবে হয়রানী করা হয় সেটা খুব দুঃখজনক ও নিন্দনীয় ব্যপার। একই সাথে ভবিষ্যতে রোগীদেরও এর ফল পেতে হবে। কারণ, এরকম ঘটনার ফলে কোন ডাক্তার আর ওধরনের লাইফ সেভিং রিস্ক নিতে যাবে না। ফলশ্রুতিতে, আপনার আমার আত্মীয় স্বজনদের ভেতরে যারা এরকম জীবন-মরনের মাঝখানে পড়ে যাবে, তাদের বেঁচে ফেলার হার শূন্যে নেমে আসবে।
সুতরাং ঐ অন্যায় গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন বন্ধুগন। ডাক্তারদের প্রতি সহানুভূতি না থাকলেও, নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে হলেও করুন।
একজন আমাকে বললেন- 'আপনি সাংবাদিক বা লেখক হলে ভালো হতো, আরো বেশি সময় দিতে পারতেন'
আমি হেসে বললাম, 'মোটেও না, বরং তখন আমাকে কলম চালাতে হতো অনেক ভেবে-চিন্তে। অনেক সত্য চেপে যেতে হতো কৌশলে, ক্যরিয়ার সুইসাইডের ভয়ে।'
মিডিয়া যাদের দখলে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে কেউ মিডিয়াতে বেশিদূর যেতে পারে না, এটা একটা নির্মম সত্য। আর ক্যারিয়ারের ঝূঁকি নিয়ে তারা সত্য বলতে যাবেই বা কেন? যাদের জন্য সত্য বলবে তাদের তো মূল্যায়ণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে, মিডিয়ার গুরুত্ব বোঝার মত ঘিলু থাকতে হবে। যারা মিডিয়ার গুরুত্ব বোঝে না তাদের পক্ষে কোন ভালো লেখক সাংবাদিক তাই যেতে চায় না, নীরবে সত্য চেপে যায়।
কিন্তু ব্লগার? তাদের ক্যারিয়ার সুইসাইডের ভয় নাই, তারা চাইলেই সত্য প্রকাশ করে দিতে পারে। এই একটা কারণে ব্লগ নিয়ে আমি অনেক আশাবাদী, যদিও এখন পর্যন্ত ব্লগারদের ভেতরে বেশির ভাগই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তবুও, অনেক অনেক দায়িত্বশীল ব্লগার নিশ্চয় একদিন পাওয়া যাবে।
একটা সত্য কথা কার পক্ষে যাবে বা কার বিপক্ষে যাবে এটা চিন্তা না করে লেখালেখিতে সততা শুধুমাত্র ব্লগারদের পক্ষেই দেখানো সহজ।